প্রকাশিত: ৩১/০৮/২০১৭ ৭:৩৬ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:১৯ পিএম

॥ নাজনীন সরওয়ার কাবেরী ॥
বিখ্যাত কবি Allen dromoglie এর ”The bridge builder” কবিতা খানা পড়েছেন কিনা জানিনা। কবিতাটির সারমর্ম হল,একজন সেতু নির্মাতা ‘একটি সেতু তৈরী করতে করতে যখন নির্মাণ কাজ শেষের পথে, তখন সেই সেতু নির্মাতার জীবন সায়াহ্নকাল।
এক পথচারী তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি এত বোকা যে, এই সেতু নির্মাণে তুমি বুড়ো হয়েছ ‘ এটা পার হতে তুমি আর সময় পাবেনা। বৃদ্ধ সেতু নির্মাতা তার পাকা গোফ দাড়ি ভর্তি মাথা নাড়িয়ে বললেন,আজ এই সেতু দিয়ে পার হবে ‘অমিত সম্ভাবনাময় এক যুবক, গোধূলির শেষ আলোয় তার পথ প্রখরিত হওয়ার জন্যই আমার এই সেতু।’
আমার বাবা সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক এমপি মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী সেই সেতুনির্মাতা। “মীর আনিসুল হাসান নামের এক প্রবাসী লেখক লিখেছেন, বাবা হচ্ছেন, সেই নিঃস্বার্থ বাতিওয়ালা, যে নিজের ঘর অন্ধকার রেখে বাতি জ্বালিয়ে ফেরেন।’
বাবার জন্ম হয়েছিল শবেবরাত এর রাতে।যখন আমার দাদীর বড় সন্তানের জন্মের পর একে একে সব সন্তানের মৃত্যু হয় তখন দাদী মানত করেছিলেন, যদি একটি সন্তান জন্ম হয় তবে মানাুষের সেবায় তাকে উৎসর্গ করে দেবে। সেই থেকেই উৎসর্গিত হওয়া। সহপাঠীদের ও প্রতিবেশীদের সহযোগীতা করতে করতে তাঁর বড় হয়ে উঠা। জমিদার বাড়ির ছেলেটাকে তাঁর,পরিবার সেযুগে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশুনা করবার সুযোগ দিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি উড়োজাহাজ করে ঢাকা ককসবাজার যাতায়াত করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় এ তিনি ডাকসুতে রাজনীতি করতেন। পৃথিবী দেখবার সুযোগ হয়েছিল কম বয়সে। পালি ও ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ ডাবল এম এ পাশ করার পর তিনি তার ভুবন জয়ী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সাজাতে নেমেছিলেন রামু কক্সবাজার কে। বিনা পারিশ্রমিক এ শিক্ষকতা করেছেন রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। যেখানে যা কিছু শিখেছেন, উদারভাবে তা শিক্ষা দিয়েছেন। এইজেলার প্রথম শহীদমিনার তৈরী করে তিনি মানুষকে মাতৃভাষার প্রতি জলভারাণত হতে শিখিয়েছিলেন। জেলার খেলাধূলা, মার্চপাস্ট, নাটক, গান, আবৃতি, দেয়ালিকা সব কিছু শেখাতে বাবার হাত সম্প্রসারিত ছিল। ৬৬ সালের ছয় দফা, ৬৯এর গণঅভ্্ূযত্থান এ বঙ্গবন্ধুর কাছের সহকারী হিসেবে বাবা দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭০সালের সাধারন নির্বাচনে বাবা ‘রামু উখিয়া টেকনাফ থেকে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসাবে দায়িত্বপালন করেছেন। একাত্তরের দেশ স্বাধীনের পর বাবার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আরো বেগবানে। যুদ্ধ বিদ্ধস্থ শুন্য দেশে বাবা অনুধাবন করেছিলেন শিক্ষা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। ঠিক সেসময় খুনিদের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু, বাবাকে দারুন নাড়া দেয়। শোক কাটিয়ে উঠবার পরই বাবা নেমে পড়েন দেশ গড়ার কাজে।
ছোটবেলায় বাবার সাথে আমাদের তেমন কোন স্মৃতি নেই। মা’ই আমাদের দেখভাল, পড়ালেখা করাতেন। একবার ঈদে আমাদের ককসবাজার শহরে নিয়ে গেলেন স্কার্ট টপস বানানোর জন্য। দরজী একে একে সবার মাপ নিচ্ছেন, বাবা সাইজ শুনে হতাস। এতো হাড্ডিসার! শেষে আমার পালা, ভাবলাম আজ বাবাকে আমার খুশি করতে হবে, আমি পেট ফুলিয়ে স্কার্টের মাপ দিলাম। বাবা বললেন বাহ্ ওর স্বাস্থ্য তো ভালই! বড় সাইজ দেখিয়ে, বাবাকে খুশি করতে পারলে ও জামাটা আমি আর ঈদে পরতে পারিনি। তিনি আমাদের প্রাত্যাহিকতা থেকে এতোটা দুরে ছিলেন বলেই হয়তো এতো ছোট বেলায় মিছে খুশি করবার চেষ্টা।।মাস শেষে, কোনসময় সপ্তাহাস্তরে বাবার পায়ের বুট জুতোর শব্দ পেতাম গভীররাতে। দেখতাম শত শত মানুষ নিয়ে মুখে কোনরকম দুটো ভাত, মুড়ি খেয়ে বাবা হাটবেন প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো পাহাড়ী পথে। কোন দিন উখিয়া, কোনদিন কচ্ছপিয়া, কোনদিন গর্জনিয়া। তখন গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলনা। প্রত্যেকটি ওয়ার্ড ইউনিয়নে যেতেন পায়ে হেটে।কোথাও মসজিদ মন্দির, কোথাও স্কুল মাদ্রাসা নির্মাণ করা ছিল তারঁ লক্ষ্য। স্কুল পরিদর্শনে আসলে, বন্ধুরা ফিসফিস করে বাবা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। যেহেতু তখনকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিলনা, সবার মতো আমরা ওখালি পায়ে স্কুলে যেতাম। গৃহহীন কে তিনি গৃহী করতেন। যেখানে অন্যায় অবিচার, তিনি নির্যাতিতের পক্ষে থাকতেন।
যখন বন্যা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ তিনি গান গেয়ে চাদাঁ তুলে মানুষের সমষ্যা সমাধান করতেন। খুব কম ঘুমোতেন বলে তাঁকে আমরা ঘুমোতে দেখিনি। কখনও টেকনাফ কখনও সদরে কখনো পাহাড়ি এলাকায় রাত্রিযাপন করতেন। শতখানেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। নারীশিক্ষায় কক্সবাজার জেলা অনগ্রসর ছিল। তাই বাবা’রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ককসবাজার মহিলা কলেজ নির্মানে এগিয়ে আসেন। ককসবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিখানা ও বাবারা দান করেছিলেন। দেশে যখন রাজনৈতিক চরম অবক্ষয়, স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবরের নাম যখন নিষিদ্ধ, বাবা দুর্বার শিল্পীগোষ্ঠিসহ অনেক সাংস্কৃতিক সংঘের জন্ম দেন। যেখান থেকে আমরা তাঁর সহযোদ্ধা হয়ে সারাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
শেখ মুজিবের বীরত্ব গাঁথা পাঠ্যবই থেকে হারালেও বাবার অসম নেতৃত্বের অবগাহনে তার সহযোদ্ধারা জয়বাংলায় স্নাত ছিলেন। মানবিক মূল্যবোধকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। শুদ্ধ কথা ও কাজের এক ভান্ডার ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পান। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের সংকট বিমোচনে তাঁর ভূমিকা আজ কাব্যগাঁথা।আপ্যায়ন ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ ভাতা, তাঁর দায়িত্ব কালিন সময়ের এইজাতীয় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা তিনি গরীব দুঃস্থদের মাঝে সরকারের মাধ্যমে দান করে ছিলেন। বাবার মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল, পরোপকার ও দেশ প্রেম।
আগষ্ট মাস বাবার জন্য একটি কষ্টের মাস ছিল। এই আগষ্টেই রমজান মাসে শবেকদরের চাঁদে বাবা চিরাচরিত নিয়মে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।আমার স্বামীর অকাল বিয়োগে তিনি আমার বন্ধু হয়েছিলেন। জীবন চলার সিদ্ধান্তে আমাকে বলেছিলেন,”The best architect is himself”. বলেছিলেন” তুমি পারবে”।যা আমাকে স্বনির্ভর হতে সাহস যুগিয়েছিল। আমাকে, তাঁর জীবনী লেখার জন্য বলে গেলেও আজ অবধি আমার সে কাজে সাহস করা হয়ে উঠেনি। এই ছোট ছোট বাক্য প্রক্ষেপণ এ তিনি আমার সত্যিকারের বন্ধু বাবা হয়েছিলেন। তাঁর উঠে আসার পেছনে দাদী ও আমার মা এর ভূমিকার কথা তিনি বেশী গুরুত্বারোপ করতেন। তার শেখানো মুল্যবোধ, দেশ প্রেম, সততার পরিমাপ এতো বেশি ছিল, ভয় পাই যদি এত স্বচ্ছতার ভার বইতে না পারি!
শেষসময়ে যখন তাঁর হাতে লাঠি, রামু জামে মসজিদ পুনঃ গঠনে হাত দিয়েছিলেন, যেকাজে অসংখ্য প্রবাসীরা সহযোগিতা করেছেন। এই অদম্য সমাজকর্মীর’ এতিমদের সহায়তার জন্য শেষ সেøাগান ছিল,”Let the orphan smile”এতোটা নিরহংকার ছিলেন,.অন্তিম শয়নের কালে বলতেন, “আমি চেষ্টা করেছিলাম” তাঁর কবরের শিয়রে লিখে গেছেন, “সৃষ্টিরে সেবিলে নাকি স্রষ্টারে মিলে, তাইতো ‘সতত চেয়েছি সেবিতে সৃষ্টিরে, জানিনা, পাব কি পাবনা তারে। দাঁড়াও পথিক একবার, হাত তুলে দোয়া মাগো, পার করে দিতে এ গুনাগারে”। বাবার এই বিশাল কর্মযজ্ঞে অনেক সহকর্মী তাঁকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি আজ কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞ আমার মায়ের প্রতি, বাবাকে সংসারের চার দেয়ালের চাহিদা থেকে মুক্ত রেখে যিনি জগত সেবার নিশ্চিন্দ্র ফুরসত দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহপাক এমন মানব সেবক মানুষটিকে জান্নাতবাসী করুন।
লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কক্সবাজার জেলা।

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...